সর্বশেষঃ

সুখের সাজানো সংসার তছনছ

এক যুগেরও বেশি সময় সৌদি আরবে থেকে ২০০৭ সালে দেশে ফিরে আসেন ফরিদপুরের কোতোয়ালির যুবক রেজাউল হাসান। ফেরার এক বছর পর বিয়ে করেন শাহিদা শারমিনকে। বছরখানেকের মধ্যেই আসে নতুন অতিথি; চার বছর পর আরও একজন। দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখে চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। এরই একপর্যায়ে জানতে পারেন, প্রাইম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি আছে, যেখানে বিনিয়োগ করলে প্রচুর লাভ পাওয়া যায়। প্রিয়জনদের ছেড়ে প্রবাস জীবনে অনেক কষ্টে অর্জিত ৪৭ লাখ টাকার সঙ্গে বোনের কাছ থেকে ২৩ লাখ টাকা এনে বিনিয়োগ করেন প্রতিষ্ঠানটিতে। বুঝতে পারেননি, প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছেন। যতদিনে বুঝলেন, ততদিনে তার সব শেষ, নিঃস্ব।

বিনিয়োগের সেই টাকা ফেরত পেতে তিনি যখন সম্ভব সব রকম চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন চেক জালিয়াতির একটি মামলা রেজাউলের ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আঘাত হানে। বোনের করা এ মামলায় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হন তিনি। পাঁচ মাস পর, ওই বছরেরই ১৪ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান তিনি।

এদিকে রেজাউলের মৃত্যুতে দুই সন্তানকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েছেন তার স্ত্রী শারমিন। সুখের সংসারে ছোবল হেনেছে সর্বগ্রাসী অভাব। উপরন্তু স্বামীর মৃত্যুতে শ্বশুরবাড়িও ছাড়তে হয়েছে তাকে। বেঁচে থাকার তাগিদে একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়েছেন শারমিন। সামান্য বেতনে এখন চলছে তার সন্তানসহ বেঁচে থাকার অসামান্য যুদ্ধ।

অন্যদিকে রেজাউল কথিত যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছিলেন, গত ৯ জানুয়ারি প্রাইম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ লিমিটেড নামের সেই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট রিয়াজুল ইসলাম রাজুকে যশোর থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এখন কারাগারে ১৮ মামলায় পলাতক এ আসামি। তার অন্যতম সহযোগী শম্পা রানী দাসের মাধ্যমে রেজাউল প্রতারণাকারী এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছিলেন। সিআইডি বলছে, রাজু-শম্পাদের চক্রের ফাঁদে পড়ে রেজাউলের মতো অন্তত ২৫শ গ্রাহক সর্বস্বান্ত হয়েছেন। রাজু ও শম্পা দুজনই প্রায় ১০ বছর রূপালী মাল্টিপারপাস নামের একটি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। এর পর ২০১০ সালে নিজেরা প্রাইম মাল্টিপারপাস নামের কোম্পানিটি খোলেন।

শাহিদা শারমিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘ও তো (রেজাউল) মরে গিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু আমার সব শেষ।’ তার কণ্ঠ আটকে আসে বুকের ভেতরের চাপা কান্নায়। বলেন, ‘কত স্বপ্ন ছিল আমাদের! সব শেষ। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে বেঁচে আছি। আমার স্বামী সারাজীবন যা উপার্জন করেছিলেন, এর পুরোটাই প্রাইম মাল্টিপারপাস মেরে দিয়েছে।’

শারমিন আরও বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারিনি ওর বোনদের কারণে। ভাড়া বাসায় উঠেছি। টিউশনি ও স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে পড়িয়ে ছেলেদের নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি। ওদিকে দেখুন… শম্পা রানী প্রতারণার টাকায় গাড়িী-বাড়ি গড়েছে, খুব সুখেই আছে। অথচ ওদের কারণেই আজ আমার এমন করুণ দশা।’ চোখে জল নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি প্রতারকদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’

রেজাউল হাসান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে ১৯৯৫ সালে একটি কোম্পানির অ্যাকাউন্ট অফিসার পদে চাকরি নিয়ে চলে যান সৌদি আরব। সেখানে ১২ বছর চাকরি করে ২০০৭ সালে ফেরেন। এর পর বিয়েÑথা, সংসার। ২০১১ সালের দিকে পরিচয় হয় প্রাইম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের অন্যতম সদস্য শম্পা রানীর সঙ্গে। তিনি রেজাউলকে প্রলোভন দেখান এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা লাভ পাবেন বলে। এ প্রলোভনে পড়ে মোট ৭৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন রেজাউল। পুরো টাকাটাই প্রতারকচক্র হাতিয়ে নিয়েছে।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, প্রাইম মাল্টিপারপাস ২০১০ সালে সনদ নিয়ে যশোর, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও মাগুরায় ২০টির মতো শাখা খুলে। এর পর আমানত দ্বিগুণ করার প্রলোভন দেখিয়ে মাত্র চার বছরে ২৫শ গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, চক্রের অন্যতম সদস্য শম্পা রানী সাহা ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিছু দিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত হন। এখন তিনি পলাতক। এ প্রতারক চক্রের অন্য সহযোগীরা বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় স্থানীয়ভাবে সমিতির নিবন্ধন নিয়ে কোম্পানি খুলে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।