বৃটেনে নির্বাচন : আলোচনায় ৪ বাংলাদেশি
বৃটেনে নির্বাচনের আর মাত্র দুই দিন বাকি। ব্রেক্সিট ইস্যু এবারও প্রার্থীদের নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠন করতে হবে তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন দলের চলছে হিসাব-নিকাশ।
নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ বা জনমত জরিপে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অনিশ্চয়তাই ফুটে উঠছে। জরিপে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ও জেরোমি করবিনের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা ওঠানামা করছে।
ব্রেক্সিট নিয়ে দোলাচলের এই নির্বাচনে বরাবরের মতো প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশিরা। রুশনারা আলী, রুপা হক ও টিউলিপ সিদ্দিকের মতো শক্তিশালী প্রার্থীর পাশাপাশি এবার নির্বাচনে আরও ছয় বাঙালি প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন।
তাদের মধ্যে লেবার দল থেকে সাতজন, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দল থেকে একজন এবং কনজারভেটিভ পার্টি থেকে একজন প্রার্থী হয়েছেন। এই ৯ প্রার্থীর মধ্যে সাতজন নারী এবং দুইজন পুরুষ। যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন পেতে দলের স্থানীয় সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার রীতি মেনেই এসব বাংলাদেশি দলের চূড়ান্ত টিকিট পেয়েছেন।
১. রুশনারা আলী
২০১০ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিতে প্রথম বাঙালি কোনো রাজনীতিবীদের অভিষেক হয়। ১৯৭৫ সালে সিলেট জেলার বিশ্বনাথে জন্মগ্রহণ করা রুশনারা আলী মাত্র সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে পাড়ি জমান।
টাওয়ার হ্যামলেটে বেড়ে ওঠা রুশনারা টাওয়ার হ্যামলেটের মালবারী স্কুল ও টাওয়ার হ্যামলেট কলেজে লেখাপড়া শেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জনস কলেজে দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ রাজনীতিতে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে এবারের নির্বাচনে যে চারজন বাংলাদেশি লড়াই করবেন তাদেরই একজন রুশনারা আলী এমপি।
যাকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দাবিদার বলে মন্তব্য করেছে বৃটেনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পত্রিকা নিউ স্টেটসম্যান।
বৈচিত্র্যপূর্ণ বৃটেনকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি লেবার পার্টিকে সরকারে ফিরিয়ে আনতে বাঙালি কমিউনিটিসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোট দিতে বললেন রুশনারা আলী ।
২.টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক
নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে এবারও হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন থেকে লড়ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বর্তমান এমপি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি। পরপর দুইবার যুক্তরাজ্যেই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
আসন্ন এই নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো প্রার্থী হয়েছেন টিউলিপ। আর এ কারণে টিউলিপের সামনে হ্যাটট্রিক জয়ের হাতছানি দিচ্ছে। লন্ডনের আসনগুলোর মধ্যে এবারও সেখানেই সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের লড়াই হবে। নব্বইয়ের দশক থেকে এ আসনটি ব্রিটেনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে।
দুই দফায় সংসদ সদস্য হওয়ার পর ব্রিটেনের নানা রাজনৈতিক ইস্যুতে পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে রীতিমত ঝড় তুলে দিয়েছিলেন টিউলিপ। সাড়ে চার বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করেই তিনি ব্রিটেনের রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন।
২০১৭ ব্রেক্সিট ইস্যুতে ছায়া মন্ত্রী থেকেও পদত্যাগ এবং নিজের নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভবনা নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন নিয়মিত। ট্রাম্পের সফরের বিরোধিতা করে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশি এই বংশোদ্ভূত ।
এছাড়া ওয়েস্ট মিনস্টার-১০ এ ভালো বক্তার তালিকায়ও প্রথম বাঙালি এমপি হিসেবে জায়গা করে নেন টিউলিপ। নির্বাচন নিয়ে সাংসদ টিউলিপ বলেছেন, ‘যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, পার্লামেন্টে সেই আসনের প্রতিনিধিত্ব করা আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। আমি হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রতিনিধি নই, আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই আসনের মানুষের প্রতিনিধি।’
৩. রুম্পা হক
ব্রিটেনে এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা প্রায় তারকাখ্যাতি নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোটারদের পছন্দের তালিকায়ও এগিয়ে থাকা গত দুইবারের নির্বাচিত আরেক বাঙালি এমপি প্রার্থী হচ্ছেন ইলিং সেন্ট্রাল ও এক্টন আসনের প্রার্থী ড. রূপা হক।
১৯৭২ সালে পাবনায় জন্ম নেয়া রুপা অধ্যাপনার পাশাপাশি একাধারে লেখক, কলামনিস্ট এবং মিউজিক ডিজে। বাবার অনুপ্রেরণায় ১৯৯১ সালে লেবার পার্টির সদস্য হন তিনি। ২০১০ সালে লন্ডনের ইলিং কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। আর এমপি নির্বাচিত হন ২০১৫ এবং ২০১৭ সালের নির্বাচনে।
পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন পাওয়া রুপা হক জানান, ‘গত দুইবারের মতো আসনটিকে ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ। অন্য কমিউনিটিসহ বাংলাদেশিদের জন্য কাজ, বাসস্থানের উন্নয়ন এবং আধুনিক স্বাস্থ্য সেবার আরও সুযোগ করে দেওয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন রুপা হক।
এছাড়া রাজনীতি ও প্রফেশনে আরও বেশি সুযোগ গ্রহণের পাশাপাশি সব সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের আশ্বাসও দিচ্ছেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারণার মাঝেই এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে লেবার পার্টির সম্পর্ক সব সময় ভালো বলে মন্তব্য করলেন রুপা। লন্ডনের কিংস্টন ইউনিভার্সিটির সিনিয়র কিংস্টন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও গতবারের নির্বাচিত এমপি ড. রুপা হক এবারও লড়ছেন লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে। ১৯৭২ সালে লন্ডনের ইলিংয়ে জন্ম নেওয়া রুপার আদি বাড়ি পাবনায়। গতবার ২৭৪ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন।
৪.আফসানা বেগম
১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের পপলার অ্যান্ড লাইম হাউস সংসদীয় আসনে সংসদ নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী হয়ে লড়ছেন আফসানা বেগম। ওই আসন লেবারের ঘাঁটি হিসেবে কমিউনিটিতে সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
এই আসনের বর্তমান এমপি জিম পিটজ পেট্রিক। ২০১০ সাল থেকে পপলার অ্যান্ড লাইন হাউস আসনে লেবার দলীয় এমপি তিনি। এর আগে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি পপলার অ্যান্ড কেনিংটাউন আসনের এমপি ছিলেন। ২০১০ সালে সংসদীয় আসনের নাম পরির্বতন করা হয় পপলার অ্যান্ড লাইম হাউস।
আপসানা বেগম টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং লেবার পার্টির লন্ডন রিজিয়নের সদস্য। একজন ব্রিটিশ বাঙালি হিসেবে ওই পদে আপসানাই প্রথম গেছেন। আপসানা বর্তমানে মোমেন্টামের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করছেন। আপসানার জন্ম এবং বড় হওয়া এই টাওয়ার হ্যামলেটসেই। তিনি টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক কাউন্সিলর এবং মেয়র প্রয়াত মনির উদ্দিন আহমেদের মেয়ে।
৫. নুরুল হক আলী
১২ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিন নর্থ সংসদীয় এলাকার লেবার দলের প্রার্থী হয়েছেন আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নুরুল হক আলী। প্রায় ২৭ বছর ধরে লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। লন্ডনের নিউহাম এলাকার বারা হতে একজন লেবার কাউন্সিলর হিসেবে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দায়ীত্ব পালন করেন। সেই সময় ডেপুটি চেয়ারম্যান ফর রিজেনারেশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা সংক্রান্ত কমিটিতে বিশেষ দায়ীত্ব নিয়ে প্রধান সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লেবার গ্রুপে সহকারি সেক্রেটারি ও ডেপুটি হুইপের দায়ীত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার ।
নুরুল হক আলী বলেন, ‘লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার আরেকটি গণভোটের আয়োজন করলে, আমি ইউরোপের থাকার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তার প্রচারণায় অংশ নিবে। ৫১ বছর বয়সী নুরুল হক আলী অসাধরণ ব্যাক্তিত্ব। স্ত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আদরের তিন কন্যাকে নিয়ে পরিবার। তিনি লন্ডনের বো এলাকার সেন্ট পল’স ওয়ে স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে। ১৯৯০ সালে ইউনির্ভাসিটি অব লিডস থেকে কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক এবং ২০০১ সালে কাস বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ শেষ করে।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক শাহানপাড়া এলাকার মিরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আসোদ্দার আলী এবং মায়ের নাম নুরুন নেছা। তিনি একজন অভিবাসী পিতার অভিবাসী সন্তান। তিনি প্রায় ৩০ বছর তেল ও গ্যাসের ব্যবসা করেন। ইউকেতে এবং আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন প্রকল্পে এবং খাতে কাজ করেন নুরুল হক আলী।
৬. মেরিনা আহমদ
যুক্তরাজ্যের মধ্যবর্তী নির্বাচনে লন্ডনের বেকেনহাম আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন বাঙালি কন্যা মেরিনা মাসুমা আহমেদ। পার্টির প্রভাবশালী সদস্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি এই আসনে এবারও নির্বাচন করার টিকিট লাভ করেছেন তিনি। এই আসনে বর্তমানে এমপি হিসেবে আছেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি।
নারায়ণগঞ্জে জন্ম নেওয়া মেরিনা আহমদ মা-বাবার সঙ্গে ৬ মাস বয়সে যুক্তরাজ্যে যান। তবে তার বাবা আর বেঁচে নেই। মা মমতাজ বেগম বর্তমানে ঢাকার বনানীতে বাস করছেন। চার ভাইয়ের সঙ্গে মেরিনা লন্ডনে বসবাস করেন। মেরিনা পাবনার কৃতি সন্তান ডা. ইমরুল কায়েসকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির রেবেকা এবং এলিজা নামে দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে মেরিনা বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন থেকেই আমি রাজনীতি সম্পর্কে বুঝতে শুরু করি। ওই সময় আমি লেবার পার্টির সম্পর্কে সেভাবে কিছু না জানলেও এই দেশ সম্পর্কে জানতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘আমি একদিন স্কুলে গিয়েছিলাম ক্যারিয়ার ব্যাগ নিয়ে। সেদিন রোডের ওপর একটি জায়গায় হেল্টিপ্যানে লেবার পার্টি সম্পর্কে লিখেছিলাম। যদিও তখন লেবার পার্টি কী আমি জানতাম না। এরপর একটা সময় রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হই। ’
ব্রিটেনে এবারের সাধারণ নির্বাচনে সর্বমোট ৬৫০ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা হচ্ছে চার কোটি ৬০ লাখ। বিভিন্ন দলের মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৩ হাজার ৩২২। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে যে কোনো রাজনৈতিক দলের এমপির সংখ্যা হতে হবে ৩২৬ জন।
এখন কোনো দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই- কনজারভেটিভ ২৯৮, লেবার ২৪৩, স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি ৩৫, লিবডেম ২০, ডিইউপি ১০, স্বতন্ত্র ২৪ জনসহ আরও ২০ জন এমপি রয়েছেন।
নির্বাচনে অন্যতম ইস্যু ব্রেক্সিট হলেও ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, অপরাধ দমন, অর্থনীতি ও ইমিগ্রেশন ইস্যু নিয়ে প্রত্যেকটি দল মানুষের কাছে তাদের ইশতেহার নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।