সর্বশেষঃ

যৌন হয়রানির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে তদন্ত প্রধানের ফোনালাপ ফাঁস

গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে(বশেমুরবিপ্রবি) দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত শিক্ষক ও তদন্ত দলের প্রধানের ফোনালাপের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। ওই ফোনালাপে সাজাপ্রাপ্ত শিক্ষক আক্কাস আলীকে উদ্দেশ করে তার পক্ষে কথা বলতে শোনা গেছে তদন্ত প্রধান অধ্যাপক মো. আব্দুর রহিম খানকে।

দৈনিক আমাদের সময়ের পাঠকদের জন্য সাজাপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে তদন্ত প্রধানের সেই ফোনালাপ তুলে ধরা হলো-

আক্কাস আলী : আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন স্যার?

তদন্ত প্রধান : ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ, ভালো আছি।

আক্কাস আলী : স্যার, আমি গত পরশুদিন জানতে পারলাম ওই মেয়ে দুটো নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসগুলোতে সিইসির যে মেয়েগুলো আছে ওদের কাছে রাতে মেসে গিয়ে থাকতো। ওরা আমার ব্যাপারে বিভিন্ন কথাবার্তা বলতো। আমরা স্যারের বিরুদ্ধে ইয়ে করবো, তোমরা মিথ্যা সাক্ষী দিবা। তো একটা মেয়ে আছে, এখন পর্যন্ত আন্দোলনে কেন যায় নাই এজন্য ওরা টর্চার করতেছে। পরে ওর অভিভাবকরা এসে প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিছে।

তদন্ত প্রধান : কোনটা? ফারজানা?

আক্কাস আলী : ফারজানা আর রেশমি ওই দুইটা মেয়ে আরকি। তবে স্যার, জানুয়ারির ২৫ তারিখে যে ঘটনা ঘটে সেটা তারা এর আগে কেন ওরা এগুলো…

তদন্ত প্রধান : না না, ঘটনাতো বোঝাই যাচ্ছে। এটা তোমাকে ফাঁসানোর জন্য করা হয়েছে। সে কথা তো আমরা বুঝতেই পারছি। তুমি আপাতত একটু চুপ থাক। পরে এগুলো সব মেকআপ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ! স্যার মোটামুটি এটাকে কুলডাউন করার জন্য এই ব্যবস্থা নিয়েছে। কথা বুঝেছো?

আক্কাস আলী : জ্বি স্যার। সেটা বুঝতে পারছি স্যার। পরিস্থিতিটাকে অন্য দিকে মোড় নিতে…

তদন্ত প্রধান : হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার দেখলো এই মূহূর্তে এমন ব্যবস্থা নিলে থেমে যাবে। এখন মোটামুটি থেমেই গেছে কিন্তু। এরপর দুই মাস পর দেখা যাবে এমনি আবার সব নরমাল হয়ে যাবে।

আক্কাস আলী : স্যার, এটা একটা ক্লু। ওরা আগে থেকেই যে ফেক আইডিগুলো আছে স্যার…

তদন্ত প্রধান : আমরা কিন্তু রিপোর্ট দিচ্ছি তোমার পক্ষে। আমরা কিন্তু তোমার খারাপ রিপোর্ট দেইনি।

আক্কাস আলী : ফেক আইডগুলো স্যার, মিথিলা হাসান,এন্থেকার তাবাসসুম, এলা মিয়া এগুলো যদি স্যার বিটিআরসি আছে না…তাহলে এগুলো বের হয়ে আসবে।

তদন্ত প্রধান : আমরা ওদের নামে কেস করেছি তো। ওদের নামে পুলিশ কেস করা হয়েছে।

আক্কাস আলী : কিন্তু আমি যে কলঙ্কিত হয়ে গেলাম,মুখ দেখাতে পারি না।

তদন্ত প্রধান :না ওটা একসময়…বিষয়টা এমন হয়ে গেল। কি আর করা যাবে।

আক্কাস আলী :এখন আমার শাস্তি যা হয় হোক স্যার। অন্য কারও শস্তি হোক না কেন, এটা যাতে প্রমাণ হয় আমি কিছু করিনি। এটা প্রমাণ হলে আমি কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবো।

তদন্ত প্রধান : সেটা ঠিক আছে। আমরা তো সেটা জানি। আমরা কিন্তু সবসময় তোমার সাথে।

আক্কাস আলী : একটা বিষয় স্যার, এ রিজনটা কিন্তু আমি স্যার তিন দিন আগেই জানতে পারছি। মিকাইল আছে না, সে প্ল্যানটা করছে সেটা কিন্তু আমি জানতে পারছি। আমি অসন্তুষ্ট না স্যার। ঠিক আছে।

তদন্ত প্রধান : তুমি কুলডাউন হয়েই থাক। এই মূহূর্তে আর…আগে ওই বেটারা জেলে যাক। তখন এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে।

আক্কাস আলী : বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এই শাস্তি আমার কাছে কিছু নয়। কিন্তু স্যার পরিবার এবং আশেপাশের সবাই জেনে গেল যে আমি…

তদন্ত প্রধান : হ্যাঁ সারা বাংলাদেশই জানলো যে তুমি একজন যৌন নিপীড়ক। উল্টোটা তো কেউ শুনতে চায় না। মুশকিল তো সেখানে।

আক্কাস আলী : এখন যদি স্যার ওই জায়গায় একটু সত্যতা নিয়ে এসে আপনারা আমাকে সেভ করেন। আপনারা থেমে যাইয়েন না, এটা আমার অনুরোধ স্যার।

তদন্ত প্রধান : না না থেমে যাইনি তো।

আক্কাস আলী : সিইসি আন্দোলনের নেতা রাশেদুজ্জামান পরাগ সেতো ফেসবুকে বলেই ফেলছে নানামুখী চাপ ও অভ্যন্তরীণ ইন্ধন। এটা স্যার আপনারা একটু যাচাই করবেন।

তদন্ত প্রধান : টেনশন নেই। তুমি মাথা ঠাণ্ডা রাখ। যদি পারো তাহলে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে নাও তাহলে আরও ভালো হয়। আমি অবশ্য ভাবলাম, সে কিছুদিন ছুটি নিয়ে থাক। একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে কুয়েতে চলে যাক। তবে মাথা রাণ্ডা রাখবা। আর বেশি অস্থির হওয়ার দরকার নেই। আর কারও সঙ্গে খুব একটা সাক্ষাৎকার দিতে যেও না।

তিনি আরও বলেন, ওরা অনেক বদমাইশ। দেখলা না তোমাকে টাকা দেওয়ার বিষয়টা। দু’নম্বরি করার জন্য তারা এটা করেছে। ওই মেয়ে বলেছে, আমি এত রাতে যাব স্যার? এটা হলো ইনটেনশনাল। আবার আমি আপনার সঙ্গে রাতে একা দেখা করবো? আমি একা আসব স্যার এগুলো ইনটেশনাল। তুমি কি বলেছ, রাতে আমার সঙ্গে দেখা কর? তুমি তো বলেছ, তুমি আমার সঙ্গে দেখা কর। পরে তো আবার বলেও দিছ, আজ কেন কাল দেখা করো।

‘একজন বলছে, না রাতেই তুমি আমার সঙ্গে হলের সামনে দেখা কর। আমরা তাকে রেকর্ড দেখাতে বলেছি কিন্তু সে আর আসেনি’, বলেন তদন্ত প্রধান আব্দুর রহিম।

তদন্ত প্রধান : কিছুদিন আড়ালে থাকলে দেখবা লোকেরা এসব ভুলে যাবে। এই মুহূর্তে তুমি গেলে বিষয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এ কারণে আমরা চাচ্ছি তুমি কিছুদিনের জন্য হলেও একটু আউটসাইডে থাক। এমনি শরীর ঠিক আছে তো। মেন্টাল প্রেশার তো যাচ্ছেই বুঝতেই পারছি।

আক্কাস আলী : সমস্যা হলো কি স্যার, যখন আমি রাস্তায় যাই। নামাজে তো যাওয়া লাগে তখন দু-এক ছাত্রছাত্রী তো অটোতে যায় আসে। অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকায়। মানুষ তো আর বিশ্বাস করতে চায় না।

তদন্ত প্রধান : হ্যাঁ খারাপটা তো মানুষ তাড়াতাড়ি গ্রহণ করে। তুমি একটা ভালো কাজ করো কেউ তাকিয়েও দেখবে না।

এ সময় আক্কাস আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন টেস্টের সফটওয়্যার তৈরি করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২-১৩ লাখ সেভ হচ্ছে প্রতি বছর। আমি এখান থেকে চার আনা পয়সা তো নেইনি স্যার। একথা তো কেউ বলে না। চেয়ারম্যান পদটাই আমার জন্য কাল হয়েছে।

তদন্ত প্রধান : হ্যাঁ সেটা না নিলেই ভালো হতো। ওটা দেওয়ার পরই তোমার সঙ্গে শত্রুতা বেড়ে গেল।

আক্কাস আলী : প্রশাসনের বিরুদ্ধে কখনো যাব না স্যার। এটা তো আমার রক্তে নাই।

তদন্ত প্রধান : তা তো চাকরি কর। প্রশাসনের বিরুদ্ধে কেন যাবা? ভুল না করলে সেটা তো বুঝাতে হবে।

আক্কাস আলী : আচ্ছা ঠিক আছে। কখন কী করা লাগে একটু বলিয়েন। আসসালামু আলাইকুম।

জানা গেছে, ওই ফোনালাপ নিজেই ফাঁস করেছেন বলে স্বীকার করেছেন সাজাপ্রাপ্ত ওই শিক্ষক। এদিকে ওই বিতর্কিত কথোপকথনের জের ধরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে উপাচার্য জানিয়েছেন, নতুন করে তদন্ত হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, বশেমুরবিপ্রবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের সাবেক প্রধান মো. আক্কাস আলী গত ডিসেম্বরে বিভাগের চতুর্থ বর্ষের দুই ছাত্রীকে থিসিসের প্রয়োজনের নামে প্রায়ই বাড়িতে ডেকে নিতেন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি যৌন হয়রানি করতেন—এমন অভিযোগের তদন্ত শেষে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে তাকে আজীবনের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট আট সেমিস্টারের জন্য সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ থেকে তাকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

পরে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মো. আব্দুর রহিম খানকে সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ড. মো. বশির উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রদানের পর কমিটি প্রধান ড. আব্দুর রহিমকে ফোন করেন আক্কাস আলী। এরপরই ওই ফোরালাপের অডিও প্রকাশ্যে আসে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।