সর্বশেষঃ

স্কুলের বিনামূল্যের বই কেজি দরে ঠোঙার দোকানে বিক্রি

প্রতিবছর ১ জানুয়ারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও সমমানের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিচ্ছে সরকার। বিনামূল্যের একটি পাঠ্যবই ছাপাতে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ২০ টাকা। এ রকম ৯টি বইয়ের ওজন হয় এক কেজি। এ হিসাবে এক কেজি বইয়ের উৎপাদন খরচ ১৮০ টাকা। অথচ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাহিদার অতিরিক্ত বই সংগ্রহ করে সেসব ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর পোস্তগোলার ভাষা প্রদীপ উচ্চ বিদ্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিক্রির জন্য মজুদ করা এমন ১৬ হাজার বই জব্দ করেছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

র‌্যাব বলছে, স্কুলটি থেকে ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১২ হাজার বই কেজি দরে ঠোঙার দোকানে বিক্রি করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে প্রধান শিক্ষিকা আফসানা শাহীন মির্জা, অফিস সহকারী ইসহাক আলী, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জড়িত। অপরাধ গুরুতর হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের কাউকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেননি। তবে স্কুলটিতে অভিযান চালিয়ে যা যা পাওয়া গেছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে চিঠি দেওয়া হবে।

অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন জানান, গত ১৯ অক্টোবর স্কুলের ভেতর থেকে ভ্যানে করে বিনামূল্যে বিতরণের বই নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন তা টের পায়। বিষয়টি জানতে পেরে র‌্যাব-১০ মঙ্গলবার রাতে স্কুলে অভিযান চালায়। এ সময় ঠোঙা বানানোর দোকানে কেজি দরে সরকারি বই বিক্রির অভিযোগের প্রমাণ পায় র‌্যাব। গত কয়েক দিনে ১০-১২ হাজার বই ধাপে ধাপে বিক্রি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি চলতি বছর যে পরিমাণ বই ডিমান্ড করা হয়েছিল তার প্রায় ২৩ হাজার এখনো বিতরণ হয়নি। এই ২৩ হাজার বই বিতরণ করা না হলে সেগুলো বোর্ডের কাছে ফেরত দেওয়ার কথা। সেটি করা হয়নি। আমরা অতিরিক্ত প্রায় ১৬ হাজার বইয়ের মজুদ পেয়েছি। এ ছাড়া যেসব স্কুলে এখান থেকে বই বিতরণ করা হয়েছে, সেখানেও গরমিল রয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম-ঠিকানা বা যথাযথ ডকুমেন্ট নেই।

অন্যায়ভাবে বই বিক্রির বিষয়ে র‌্যাব ১০-এর উপঅধিনায়ক বলেন, স্কুলটি তাদের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বই বোর্ডে ফেরত দেয়নি। আমরা তথ্য পাই, বইগুলো অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে বইগুলো তারা বিক্রি করছে। গতকালও ঠোঙা বানানোর দোকানে বিনামূল্যে বিতরণের বই বিক্রি করা হয়েছে। অভিযান শুরু করলে প্রথমে স্কুল কর্তৃপক্ষ বই বিক্রির বিষয় অস্বীকার করে। পরে স্কুলের নথিপত্র দেখে অনিয়ম পাওয়া যায়।

অতিরিক্ত বইগুলো কেন স্টোরে জানতে চাইলে স্কুল কর্তৃপক্ষ র‌্যাবকে জানিয়েছে, আগামী বছর ব্যবহারের জন্য সেগুলো রাখা হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালের জন্য স্কুলের বই চেয়ে যে চাহিদা পাঠানো হয়েছে, সেখানে এই বছরের তুলনায় ৩ থেকে ৪ হাজার বই বেশি চাওয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে র‌্যাব।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, র‌্যাবের অভিযানের বিষয়টি আমি জানি না। তবে বিভিন্ন সময়ে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, অনেক শিক্ষা কর্মকর্তা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে বই নিয়ে থাকে। ভাষা প্রদীপ উচ্চ বিদ্যালয়ের ঘটনাটি খোঁজ নিয়ে পরে বলতে পারব।

এনসিটিবির মেথড অনুযায়ী, একটি বই ছাপাতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ব্যয় হয় ১৯ টাকা ৮৫ পয়সা। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিতে বই রয়েছে ১৪টি করে। এই শ্রেণির এক সেট বই ছাপাতে খরচ হয় ২৭৭ টাকা ৯০ পয়সা। এ ছাড়া নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শাখা বিভাগে ১৮টি করে এবং মানবিক বিভাগে ১৭টি বই পাঠ্যক্রমে রয়েছে। ওজনে হিসাব করলে এক কেজিতে হয় ৯টি বই। একশ্রেণির ১৪টি বইয়ে দেড় কেজির মতো।

এ হিসাবে ভাষা প্রদীপ উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ১২ হাজার বই বিক্রি করে, এর ওজন হয় এক হাজার ৩৩৩ কেজি। যার সরকারি উৎপাদন মূল্য ২ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকা। অথচ ১০ টাকা কেজি দরে বইগুলো বিক্রি করা হলে এর দাম আসে মাত্র ১৩ হাজার ৩৩০ টাকা।

এনসিটিবির সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, পাঠ্যপুস্তকের সঠিক চাহিদা নিরূপণ, উৎপাদন এবং বিতরণে দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বছরে কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রের অপচয় হচ্ছে। একদিকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরে কেজি দরে বিক্রি করছে। অন্যদিকে সরকারি গুদামেও বছরের পর বছর ছাপানো বই মজুদে নষ্ট হয়।

এ বিষয়ে অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, আগামীতে সঠিক চাহিদা নিরূপণের লক্ষ্যে ডিজিটাল ডেটা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এ নিয়ে কাজ করছে। সব শিক্ষার্থীর ইউনিক আইডি হবে। তখন আর অতিরিক্ত চাহিদা দিতে পারবে না। প্রথম শ্রেণিতে কত শিক্ষার্থী ছিল, কত পাস করল, কত ফেল করল সেটি সফটওয়্যারে মনিটরিং করব। কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা তথ্য নিয়ে বইয়ের চাহিদা নিরূপণ করতে পারব।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।