টক অব দ্য কান্ট্রি ‘সম্রাট’
সারাদেশে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অব্যাহত অভিযানে তার বিশ্বস্ত দুই ভ্যানগার্ড খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীম গ্রেফতার হন। এরপর থেকেই তিনি গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন।
চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে সম্রাটকে গ্রেফতার করা হবে কি না তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন। গ্রেফতারের আশঙ্কায় কয়েক দিন কাকরাইলে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করেছেন। কিন্তু এখন হদিস নেই। এরই মধ্যে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাবও তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
পরিস্থিতি যখন এমন তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন-সম্রাটকে ধরতে আইনশৃড়খলা বাহিনী কি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছে। অনেকে বলেন, তিনি এরই মধ্যে আইনশৃড়খলা বাহিনীর হেফাজতে চলে গেছেন। কেউ বলেন, ক্যাসিনো গডফাদার সম্রাট গোয়েন্দাজালে আটকা পড়েছেন। তবে গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় থাকার বিষয়টির সমর্থন মিলেছে আইনশৃড়খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কথায়ও।
তারা বলেন, এ বিষয়ে তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছেন। সিগন্যাল পেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে। তাকে বর্তমানে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় গ্রেফতার দেখানো হতে পারে সম্রাটকে। একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে গত দুই দিন ধরে সম্রাটকে গ্রেফতারের জল্পনা জোরালো হয়েছে। তাকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে গুঞ্জন চাউর হয়েছে। যদিও আইনশৃড়খলা বাহিনী এ বিষয়ে এখনো মুখ খুলছে না। সম্রাটের গ্রেফতারের বিষয়ে তথ্য জানতে ডিএমপি কার্যালয়ে সাংবাদিকরা ভিড় করছেন। গত বৃহস্পতিবার সম্রাটের গ্রেফতারের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ তার এই বক্তব্য ঘিরে জল্পনা আরো দৃঢ় হয়। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, সম্রাটকে আটক করেছে আইনশৃড়খলা বাহিনীর কোনো একটি ইউনিট। আবার তাকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে বলেও জোরালো গুঞ্জন চলে। কিন্তু গতকাল সোমবার রাত ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়নি।
আবার বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা সম্রাটকে কোনো একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আটক করেছে। তাকে ক্যাসিনো ব্যবসার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হতে পারে। এসব জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই গত রোববার সকাল থেকে রাজধানীতে ডিএমপি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ভিড় জমে। ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটের সর্বশেষ অবস্থার তথ্য জানতে মুখিয়ে আছেন সাংবাদিকরা। যদিও আইনশৃড়খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।
এর আগে শনিবার সম্রাটের গ্রেফতারের বিষয়ে রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘দেখবেন, আপনারা শিগগিরই দেখবেন। ‘সম্রাট’ হোক আর যেই হোক, অপরাধ করলে তাকে আমরা আইনের আওতায় আনব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকেই সম্রাটের গ্রেফতারের গ্রিন সিগন্যাল পায় আইনশৃড়খলা বাহিনী। এর পরই তাকে আটক করা হয় বলে জল্পনা শুরু হয়।
কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হতে পারেন যুবলীগের এই প্রভাবশালী নেতা। কিন্তু তার গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়ায় অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, অধরাই থেকে যাচ্ছেন ক্যাসিনো সম্রাট। কিন্তু সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, সম্রাট গ্রেফতার এড়াতে নানা ফন্দিফিকির করলেও তার রেহাই নেই। তার গ্রেফতার নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন ও গুজব। তবে সম্রাটকে নিয়ে এই গুঞ্জন ও গুজবের নতুনমাত্রা পেয়েছে।
চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যুবলীগের কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর সম্রাটের নাম আসতে থাকে গণমাধ্যমে। আইনশৃড়খলা বাহিনীর সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রতি রাতে ৪০ লাখ টাকা রাজধানীর ১৫টি ক্যাসিনো থেকে চাঁদা হিসেবে পেতেন সম্রাট। তার দুই আস্থাভাজন খালেদ ও জিকে শামীম গ্রেফতারের পর নড়ে বসেন তিনি। এ দুজনই অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন সম্রাটকে। তারা গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো সাম্রাজ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে দেন। এতে করে বেকায়দায় পড়েন সম্রাট। এরপর গ্রেফতার এড়াতে নানা মহলে লবিং শুরু করেন।
ক্যাসিনো, দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী সরকারের কঠোর মনোভাবে অবস্থা বেগতিক দেখে সম্রাট আত্মগোপনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। শুরুতেই ঘন ঘন অবস্থানও পরিবর্তন করেন। যুবলীগের কার্যালয় থেকে ‘ছদ্মবেশ’ নিয়ে বেরিয়ে যান। এরপর দুটি ঠিকানা বদলের পর তিনি নির্ভরযোগ্য স্থানে চলে আসেন। বর্তমানে এখানেই পালিয়ে আছেন। কারো কারো মতে, সম্রাট কাকরাইলের অফিস থেকে বের হয়ে ঢাকার বাইরে চলে গেছেন। সীমান্তবর্তী কোনো এক জেলা থেকে তিনি দেশ ছাড়বেন। তবে পুলিশসহ আইনশৃড়খলা বাহিনীর সূত্রগুলোর দাবি, সম্রাট দেশেই আছেন। ঢাকায়ই অবস্থান করছেন। তাদের নজরদারিতেই আছে।
পরিস্থিতি দেখে সম্রাটও মোটামুটি নিশ্চিত যে, তিনি গ্রেফতার হবেন। কাজেই যেকোনোভাবে গ্রেফতার এড়াতে সব ধরনের চেষ্টা করেছেন তিনি। তদবির করছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার কাছে। কিন্তু এ সময়ে কেউ তার পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছেন না। অধিকাংশই এড়িয়ে চলছেন। তার ফোনও ধরছেন না। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অভিযানের বিষয়ে রয়েছেন কঠোর অবস্থানে।
র্যাবের অভিযানে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতেই যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতার হন। ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন জি কে শামীম। এদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে আসে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটই ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো পরিচালনার মূল ব্যক্তি। তার হাত ধরেই ঢাকায় ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে। সহযোগীদের মাধ্যমে তিনি ক্যাসিনো সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য তিনি ঘনিষ্ঠদের দায়িত্ব দেন। তারা আস্থার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নিয়মিত অর্থ তুলে দিতেন সম্রাটের হাতে। এ অর্থের বড় একটি অংশ ভাগ হয়ে বিভিন্ন হাতে চলে গেছে। বাকি অংশ গেছে নিজের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে। এ ছাড়া টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে জিজ্ঞাসাবাদে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্রাটের শিষ্য খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি কাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন। সম্রাটের ক্যাসিনোর দেখাশোনা করতেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ। তারা এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম-জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেছিলেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর মমিনুল হক সাঈদও সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান।